আকাশে প্রতিমুহূর্তে কমপক্ষে ১০ হাজার উড়োজাহাজ উড়ছে। এমন বাস্তবতায় অনেকের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়-‘উড়োজাহাজ কি গাড়ি বা নৌযানের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?’ বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনার আগমুহূর্তে বিমানযাত্রী ও ক্রদের অসহায়ত্ব, নির্মম মৃত্যু সারাবিশ্বের প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আকাশপথে ভ্রমণ নিয়ে একপ্রকার মানসিক চাপ এবং ভীতি জন্ম নেয়। তবে বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বিমান বিধ্বস্তের হার অন্যান্য পরিবহন ও নৌযান দুর্ঘটনার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
যে কোনো সময় গড়ে প্রায় ৯,০০০-১২,০০০ বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ আকাশে উড্ডয়নরত থাকে। উড়োজাহাজ ট্র্যাকিং সার্ভিস ফ্লাইট রাডার-২৪ এর মতো তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় গড়ে দুই লাখের বেশি ফ্লাইট পরিচালিত হয় বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে যাত্রীবাহী, মালবাহী (কার্গো) এবং সামরিক ফ্লাইটও রয়েছে। প্রতি মিনিটে আকাশে ওঠে এবং নামে কয়েক’শ বিমান।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন মাধ্যমগুলোর অন্যতম হচ্ছে উড়োজাহাজ। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইসিএও) এবং এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক (এএসএন) এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ ফ্লাইটের মধ্যে গড়ে মাত্র একটি দুর্ঘটনায় পড়ে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী ৪৫০ কোটি যাত্রী বিমানে যাত্রা করেন, যার মধ্যে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ১০০–১৫০ জনের। মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এক কোটি ফ্লাইটে মাত্র ১টি।
অন্যদিকে, সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর তথ্য অনুযায়ী,প্রতিবছর প্রায় ১৩ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৩,৫০০ জনের বেশি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শঙ্কা বিমানের চেয়ে প্রায় ১০,০০০ গুণ বেশি।নৌপথ এবং রেলপথও তুলনামূলকভাবে বিমানের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও দুর্ঘটনার সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, তবে একবারে অনেক মানুষের প্রাণহানির শঙ্কা থাকে।নৌ দুর্ঘটনায় প্রায়শই জীবন সুরক্ষার ব্যবস্থা দুর্বল থাকে, ফলে ঝুঁকি বাড়ে। রেল দুর্ঘটনাগুলো অঞ্চলভেদে ভিন্ন হলেও যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে।
প্রচারণা বনাম পরিসংখ্যান: ‘বিমানে ভ্রমণ নিরাপদ’ হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের বড় কারণ হলো দুর্ঘটনা হলে তা হয় প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক এবং সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হয় ব্যাপকভাবে। এতে করে বাস্তবতায় ঝুঁকির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক ভয় বেড়ে যায়। অপরদিকে, সড়ক দুর্ঘটনা যেহেতু খুব সাধারণ, তাই সেটি অনেক সময় গুরুত্ব পায় না।
আকাশপথ সত্যিই কি বেশি নিরাপদ? এমন প্রশ্নের উত্তর নিঃসন্দেহে ‘হ্যাঁ’। আধুনিক প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ও পাইলটদের কঠোর প্রশিক্ষণের কারণে বিমান ভ্রমণ আজ পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ যাতায়াত মাধ্যম। এটি যতই বিস্ময়কর শোনাক না কেন, বিমানে চড়লে আপনি গাড়ি বা নৌযানে ওঠার তুলনায় অনেক কম ঝুঁকিতে থাকেন।
তাই, ভয় নয়-যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন। ‘উড়োজাহাজ’ শুধু সময় বাঁচানো বা দূরত্ব কমানোর মাধ্যম নয়, বরং নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ‘বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের হার এইচআইভি, যক্ষ্মা ও হত্যার শিকার হয়ে প্রাণহানির সংখ্যার চেয়েও বেশি। তবুও মানুষ এসবকে প্রাকৃতিক বা অনিবার্য বলে মেনে নেয়। অথচ বিমান দুর্ঘটনা, যদিও খুব বিরল, সেটিকে অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক ও ভয়াবহ বলে বিবেচনা করে থাকে।
ক্যাপ্টেন চেসলি সুলি সালেনবার্গার ‘মিরাকল অন দ্য হাডসন’ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক উড়োজাহাজের পাইলট ছিলেন, তিনি বলেন, ‘আকাশপথ এখন ইতিহাসের সবচেয়ে নিরাপদ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল পরিবহন ব্যবস্থা-তবুও এটিই সবচেয়ে নিরাপদ।’ আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা আইএটিএ’র সাবেক মহাপরিচালক টনি টাইলার বলেন,‘প্রতিদিন এক লাখেরও বেশি ফ্লাইট নিরাপদে উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। বিমানশিল্প পর্যাপ্ত নিরাপত্তাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার উপর নির্মিত।’ এমআইটির পরিসংখ্যানবিদ ড. আর্নল্ড বারনেট যিনি কয়েক দশক ধরে বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছেন, বলেন ‘আপনি যদি প্রতিদিন একটি করে ফ্লাইটে চড়েন, তাহলে একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়তে আপনার প্রায় ৫৫,০০০ বছর সময় লাগবে।